সুরা ফাতিহা: সূচনা, অর্থ এবং ফজিলত
সুরা ফাতিহা কোরআন শরিফের প্রথম সুরা। 'ফাতিহা' শব্দের অর্থ হলো 'সূচনা', 'উদ্বোধন' বা 'প্রারম্ভিকা', যা এ সুরার গুরুত্ব নির্দেশ করে। নামাজে অন্য যেকোনো সুরা পড়ার আগে সুরা ফাতিহা পড়তে হয়। অর্থাৎ, নামাজের মধ্যে অন্য সুরা বা আয়াতগুলো পড়ার আগে সুরা ফাতিহার পাঠ আবশ্যক।
সুরা ফাতিহা এমন একটি সুরা, যেখানে যখন একজন মুমিন একটি করে আয়াত পাঠ করেন, আল্লাহ তাআলা সঙ্গে সঙ্গে সেই আয়াতের জবাব দেন। এটি যেন আল্লাহর সঙ্গে তাঁর বান্দার সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম।
সুরা ফাতিহার বাংলা উচ্চারণ:
- আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন
- আর রাহমানির রাহিম
- মালিকি ইয়াওমিদ্দিন
- ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাইন
- ইহদিনাছ ছিরাতল মুস্তাকিম
- ছিরাতল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম
- গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দল্লিন
সুরা ফাতিহার অর্থ:
১. সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই।
২. যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়;
৩. বিচার দিনের মালিক।
৪. আমরা তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি;
৫. তুমি আমাদের চালিত করো সঠিক পথে,
৬. তাঁদের পথে, যাঁদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ,
৭. যারা (তোমার) রোষে পতিত হয়নি, পথভ্রষ্ট হয়নি।
এই সাতটি আয়াতের মধ্যে প্রথম তিনটিতে আল্লাহর পরিচয় এবং শেষ তিনটিতে আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা প্রকাশিত হয়েছে।
আল্লাহর পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়, কারণ তিনিই মহাবিশ্বের প্রতিপালক। তিনিই আমাদের মাফ করার চূড়ান্ত অধিকারী। তিনি যেহেতু বিচার দিবসের মালিক, সেই বিচারে তিনিই আমাদের প্রতি দয়া বর্ষণ করার একমাত্র ত্রাণকর্তা।
সুরার শেষ তিন আয়াতে আমরা আল্লাহর কাছে সরল পথের নির্দেশনা চাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসুলদের যে পথে চালিত করেছেন, সেটি হলো সঠিক পথ। যিনি নবী-রাসুলদের পথ দেখিয়েছেন, তিনি ছাড়া আমাদের কেউ সর্বোত্তম পথ দেখাতে পারেন না।
নামাজে অন্য যেকোনো সুরা পড়ার আগে সুরা ফাতিহা পড়তে হয়। সুরাটির পঞ্চম আয়াতে আল্লাহর কাছে আমরা সরল পথ দেখানোর অনুরোধ করেছি। এরপরের আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাদের পরম অনুগ্রহ দিয়েছেন, তাঁদের পথটি হলো এ সরল পথ, যাঁরা পথভ্রষ্ট হননি এবং আল্লাহর ক্রোধেরও শিকার হননি।
প্রথম অংশে আল্লাহর পরিচয় ও শেষ অংশে আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যাশার মধ্যে বলা হয়েছে, ‘ইয়া কানা বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন।’ অর্থাৎ, ‘আমরা তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ এই আয়াত আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের প্রতীক। তাঁর কাছে আমাদের নিঃশর্ত আত্মনিবেদনের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের একমাত্র ইবাদত আল্লাহর জন্য।
সুরা ফাতিহার ফজিলত:
মহানবী (সা.) একদল সাহাবিকে একটি সামরিক অভিযানে পাঠালেন। তারা একটি লোকালয়ে পৌঁছালেন, কিন্তু সেখানকার লোকজন তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাল না। একটি রাতে গোত্রপ্রধানকে সাপে কামড় দিল এবং চিকিৎসকেরা তার বিষ নামাতে পারলেন না। তখন লোকজন সাহাবিদের কাছে এল এবং তাদের সাহায্য চাইল।
এক সাহাবি বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে যদি তিনি সুস্থ হন, তাহলে এর বিনিময়ে কি হবে?’ লোকজন জানাল, ‘৩০টি বকরি পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছে।’ সাহাবিরা রাজি হলেন এবং সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত শুরু করলেন। তারা সাতবার সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে সামান্য থুতু নিয়ে ক্ষতস্থানে মেখে দিলেন। কিছুক্ষণ পর গোত্রপ্রধান সুস্থ হয়ে গেলেন।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাহাবিদের ৩০টি বকরি পুরস্কার দেওয়া হলো। সাহাবিরা মনে করলেন, এই বকরিগুলো তো আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করে পাওয়া হয়েছে, সুতরাং এগুলো খাওয়া কি হালাল হবে? তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললেন।
মহানবী (সা.) বললেন, ‘তোমরা কী করে জানলে যে সুরা ফাতিহা দিয়ে রোগের চিকিৎসা হয়? আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি।’ এরপর তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘এগুলো সবার মধ্যে ভাগ করে দাও এবং আমার জন্য একটি অংশ রেখো।’
এই হাদিসটি আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। এটি বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ আছে।
সুতরাং, সুরা ফাতিহার মধ্যে কেবল উপাসনা ও প্রার্থনা নয়, বরং এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা এবং রোগের চিকিৎসারও স্বীকৃতি পাওয়া যায়। সুরা ফাতিহার গুরুত্ব ও ফজিলত আমাদের জীবনে অপরিসীম।